
মাতসুশিমা সুমাইয়া
বাংলাদেশি বাবা মাসুদুর রহমান চাননি মেয়ে লাল-সবুজের জার্সি গায়ে জড়াক। কিন্তু জাপানি মা মাতসুশিমা তমোমির সঙ্গে গোপনে বাংলাদেশের পাসপোর্ট করেন মাতসুশিমা সুমাইয়া। দুই বছর আগে বসুন্ধরা কিংসের ট্রায়ালে টিকে যাওয়া জাপানপ্রবাসী এই নারী ফুটবলার এখন জাতীয় দলের অন্যতম তারকা। কোচ পিটার বাটলার ইস্যুতে সাফজয়ী এই সদস্যকে হত্যা ও ধর্ষণের হুমকি দেওয়া হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
মঙ্গলবার সোশ্যাল মিডিয়ায় সুমাইয়া নিজেই হুমকির কথা লিখেছেন। হুমকি দেওয়াসহ নারী ফুটবলারদের আন্দোলনের বিষয়গুলো নিয়ে সমকালের সঙ্গে মন খুলে কথা বলেছেন মাতসুশিমা সুমাইয়া।
নিউজ জার্নাল ২৪ ফেসবুকে লিখেছেন, আপনি হত্যা ও ধর্ষণের হুমকি পাচ্ছেন?
সুমাইয়া: সোশ্যাল মিডিয়া থেকে আমি এই হুমকিগুলো পাচ্ছি। আমার যে পেজ আছে, সেখানে অনবরত বাজে কমেন্টস করা হচ্ছে। আমার এই স্ট্যাটাসের পর অনেক কমেন্টস ডিলিট করে দিয়েছে। যখন থেকে এই বিষয়গুলো (মেয়েদের আন্দোলন) সামনে এসেছে, তখন থেকেই হুমকি পাচ্ছি।
নিউজ জার্নাল ২৪: কোন কারণে আপনাকে হুমকি দিচ্ছে?
সুমাইয়া: কোচের বিপক্ষে চিঠি দেওয়া নিয়ে বাজে অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছি। যা সত্যি, সেটাই আমরা চিঠিতে লিখেছি। আমরা তো বাড়তি কিছু লিখিনি কিংবা বানোয়াট কিছু লিখিনি। তদন্ত কমিটির কাছে বলেছি, চিঠিটি আমি লিখেছি। আমরা ১৮ জন মিলে যে ফাইট করছি, আমি ওদের সঙ্গে শেষ পর্যন্ত থাকতে চাই। আমাদের একটিই চাওয়া– কোচ (বাটলার) পরিবর্তন করা হোক। মানসিক যন্ত্রণা আমরা আর নিতে পারছি না। ফুটবলে শুধু ট্রেনিং, ট্যাকটিকস এগুলোই নয়; একটা প্লেয়ারের ভালো পারফরম্যান্সের জন্য মানসিক শান্তিটা প্রয়োজন।
নিউজ জার্নাল ২৪: সোশ্যাল মিডিয়ায় যারা আপনাকে হুমকি দিয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেবেন?
সুমাইয়া: আমি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব। সাইবার বুলিংয়ের কারণে মামলা করব। যেসব মেসেজ দিয়েছে, সেগুলো আমি উপস্থাপন করব। আমি একটা লক্ষ্য নিয়ে বাংলাদেশে এসেছি। এখানে মাইনোরিটি (প্রবাসী ফুটবলার) বলতে একজনই আছি, সেটা আমি। কিন্তু ইংলিশ মিডিয়ামের শিক্ষার্থী, যারা ভালো ব্যাকগ্রাউন্ডের, তাদের পরিবার কিন্তু মেয়েদের খেলাধুলায় দিতে চায় না। আমি এটার জন্যই লড়াই করছি। আমি ফুটবল খেলছি, যেন এসব জায়গায় যারা আছে, তারা আমাকে দেখে ফুটবলে আসে। এ মুহূর্তে যে পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, তাতে আমি ওই সব পরিবারের মেয়েদের কীভাবে বলব, আমার মতো স্পোর্টসে আসো। আপনারা আপনাদের বাচ্চাদের ফুটবল কিংবা ক্রিকেটে দেন, সেই কথা কীভাবে বলব? আমাদের দেশের জন্য এত বড় অর্জন করে আসছি (সাফ চ্যাম্পিয়ন), অথচ এই জনগণই আমাদের হুমকি দিচ্ছে। একজন ব্রিটিশের কারণে তারা আমাদের মূল্য দিচ্ছে না। এই কঠিন সময়ে মেয়েদের পাশে কেউ নেই।
নিউজ জার্নাল ২৪: এ মুহূর্তে আপনাদের ক্যাম্পে নিরাপত্তার অভাব রয়েছে কি?
সুমাইয়া: অবশ্যই, আমরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। আমাদের কি নিরাপত্তা আছে? যারা কমেন্টস করেছে, যারা মেসেজ পাঠিয়েছে, তারা কি আমাদের ফলো করবে না? কোথাও দেখলে আমাদের আক্রমণ করবে না? শঙ্কা কাটাতে পারছি না। এখন তো সবাই জেনে গেছে, আমরা কী? কেউ যদি মারা যায়, তাহলে এর দায়িত্ব কে নেবে? আপনি মেয়েদের যার যার গ্রামে পাঠিয়ে দিলেন, সেখানে ওদের কিছু হলে কে দেখবে?
নিউজ জার্নাল ২৪: বাফুফের এক কর্মকর্তা বলেছেন, হুমকির ব্যাপারটি আপনার ব্যক্তিগত।
সুমাইয়া: চুক্তি না থাকলে মরি বা বাঁচি, সেটি তাদের (বাফুফে) কিছু না? এটা তো আমি ব্যক্তিগতভাবে নিতে পারছি না। যদি তাদের দায়িত্ব না হয়, তাহলে আমরা মারা যাই সমস্যা নাই।
নিউজ জার্নাল ২৪: সাফজয়ী দলের একজন সদস্য হিসেবে কখনও কি ভেবেছেন, এ রকম বাজে পরিস্থিতির সামনে পড়বেন?
সুমাইয়া: আমার বাবার সঙ্গে ফাইট করে বসুন্ধরা কিংসে ট্রায়াল দিয়েছিলাম। সে সময় তিনি বলেছিলেন, তুমি এখানে (বাংলাদেশ) খেল না, এখানে খেললে ভালো হবে না। তুমি বিদেশে খেল। বাংলাদেশে তোমাকে কিন্তু খেলতে দেবে না। কিন্তু আমি আমার মায়ের সঙ্গে লুকিয়ে পাসপোর্ট বানাই। কিংসে ট্রায়ালে টেকার পর মালদ্বীপেও লিগ খেলেছি। এখন আমার নামে কত উল্টাপাল্টা লেখা হচ্ছে। পারফরম্যান্স না থাকা সত্ত্বেও আমাকে নাকি টিমে রাখা হয়েছে সাবিনা খাতুনের জন্য। আমার যদি পারফরম্যান্স না থাকত, তাহলে কোচ (পিটার বাটলার) বাদ দেওয়ার তালিকায় আমার নাম রাখতেন।
নিউজ জার্নাল ২৪: সোশ্যাল মিডিয়ায় আপনাকে হুমকির ব্যাপারে পরিবার থেকে কী বলছে?
সুমাইয়া: আমার মা সব সময় আমাকে সাপোর্ট দেন। প্রথমে আমার বাবা অনেক ভয় পেয়েছিলেন, আমি বাংলাদেশে খেলব, সবাই চিনবে আর এই চেনাই ছিল তাঁর ভয়ের কারণ। পাবলিক ফিগার হওয়া একটা ঝুঁকিরও বিষয় আছে। সবাই আপনাকে রাস্তায় দেখবে। এখন আমি যে বাইরে যাব, সেই নিরাপত্তা নেই। কারণ আমি খোলামেলা হুমকি পাচ্ছি, সেখানে কেউ কোনো প্রতিবাদ করছে না। শুধু আমাকেই নয়, অনেককেই হুমকি দিচ্ছে। সেগুলোর ভয়ে আমি সোশ্যাল মিডিয়া বন্ধ করে দিয়েছি। এ জন্য একটা স্ট্যাটাস দিয়েছি, যেটা কেবল আমিই সাহস করে দিয়েছি।
নিউজ জার্নাল ২৪: নারী ফুটবল কমিটির চেয়ারম্যান মাহফুজা আক্তার কিরণ আপনাদের ফেরার আহ্বান জানিয়েছেন। তার পরও নমনীয় হলেন না কেন?
সুমাইয়া: যেখানে আমরা মানসিক শান্তি পাব না, সেখানে আমরা কীভাবে খেলে দেশের জন্য পারফর্ম করব? বারবার কেবল টিকটকের বিষয়টি সামনে আনা হচ্ছে। আমি সারাজীবন বাবা-মায়ের সঙ্গে ঈদ করেছি। এখানে আসার পর ঈদটা ক্যাম্পে করতে হয়েছে; কারণ আমার দেশকে প্রতিনিধিত্ব করতে হবে। আমরা যদি অবসর সময়ে একটা ভিডিও বানাই, তাতে সমস্যা কী? ঠোঁটে লিপবাম দেওয়া নিয়েও তাঁর (বাটলার) আপত্তি। ঠোঁট শুকিয়ে গেলে লিপবাম দেব না? ভুটানের সঙ্গে ম্যাচের আগে আমি নিজে শুনেছি সানজিদা-সাগরিকাকে কোচ বলেছেন– তোমরা কি এখানে মডেলিং করতে এসেছো? আপনি দেখেন, ব্রাজিলের নারী ফুটবলার মার্তা, তিনি লাল লিপস্টিক দিয়ে মাঠে নামেন। আমরা তো লিপবাম দিই। খেলতে খেলতে দৌড়াতে দৌড়াতে ঠোঁট শুকিয়ে যায় আমাদের। আবার মাথায় ব্যান্ড দিলেও আপত্তি।
নিউজ জার্নাল ২৪: চিঠিতে বডি শেমিংয়ের কথা লিখেছিলেন আপনারা...
সুমাইয়া: জানি, ‘বডি শেমিং’ কতটা ভারী শব্দ। আমাদের অনেক উল্টাপাল্টা কথা বলা হয়েছে। আমরা কখনও যৌন হয়রানির শিকার হইনি।
নিউজ জার্নাল ২৪: গুঞ্জন উঠেছে, বিদ্রোহের কারণে ৮-১০ জন মেয়ে ঝরে পড়তে পারে। সেখানে যদি আপনার নাম আসে, তখন কী করবেন?
সুমাইয়া: আমি শেষ পর্যন্ত লড়ব। সভাপতি ইংল্যান্ড থেকে এলে আমাদের একটা সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেবেন। ‘যাও বা থাকো’– যে কোনো একটা তো বলবেন। আমরা সবকিছুতেই প্রস্তুত থাকব। এর বাইরে আমাদের বলার কিছু নেই। আমাদের অভিযোগগুলো জানিয়েছি। সেগুলো যদি সমস্যা না লাগে, তাহলে আমাদের ক্যাম্প থেকে বের করে দেবে।