ছবি সংগৃহীত
আমল পরিপালনের ক্ষেত্রে ইসলামে মধ্যপন্থা অবলম্বনের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। রাসুল (সা.) বলেছেন, তোমরা আমলে মধ্যপন্থা অবলম্বন করো, বাড়াবাড়ি করো না। সকাল-সন্ধ্যায় (ইবাদতের জন্য) বের হয়ে পড়ো এবং রাতের কিছু অংশেও। তোমরা অবশ্যই পরিমিতি রক্ষা করো। তাহলে গন্তব্যে পৌঁছতে পারবে।’ (বুখারি শরিফ, হাদিস : ৬৪৬৩)
মানবজীবনে মধ্যপন্থা অবলম্বনের ফজিলত সম্পর্কে আরও একাধিক হাদিস বর্ণিত হয়েছে। ইসলামে মধ্যপন্থা প্রশংসিত জেনেও আমাদের মধ্যে তা অবলম্বনের ঘাটতি দেখা যায়। শবে বরাতের ক্ষেত্রে বিষয়টি আরও প্রকট। মানে আমরা এ রাতের আমল ও করণীয় সম্পর্কে দুই ভাগে বিভক্ত; এক শ্রেণি বাড়াবাড়িতে লিপ্ত, আরেক শ্রেণি ছাড়াছাড়িতে। কেউ শবে বরাতকে সর্বশ্রেষ্ঠ রজনী আখ্যা দেন, আবার কেউ এটিকে একটি সাধারণ রাতের চেয়ে বেশি কিছু মনে করেন না। অথচ বিষয়টি এমন নয়; বরং এখানেও যদি আমরা মধ্যপন্থা অবলম্বন করি, তাহলে সঠিক সিদ্ধান্তের ওপর থাকতে পারি। শবে বরাতে মধ্যপন্থা ও সঠিক সিদ্ধান্ত কী এবং আরও কিছু আনুষঙ্গিক বিষয়ে আলোচনা করা হলো–
শবে বরাত কী?
পবিত্র রমজানের আগের মাস শাবানের ১৪ তারিখ দিনগত রাত ‘শবে বরাত’ নামে প্রসিদ্ধ। শব্দ দুটি ফারসি ভাষা থেকে এসেছে। ‘শব’ মানে রাত, ‘বরাত’ মানে মুক্তি। বরাত আরবি ‘বারাআতে’র সমশব্দ। যার অর্থও মুক্তি। পবিত্র কোরআনেও ‘বারাআত’ শব্দটি মুক্তি অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। তাই শবে বরাত অর্থ হবে মুক্তির রাত। কিন্তু হাদিস শরিফে এ রাতকে ‘শবে বরাত’ নামে আখ্যায়িত করা হয়নি; বরং একে বলা হয়েছে–‘লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান’ বা ‘শাবান মাসের মধ্য রজনী’।
শবে বরাতের ফজিলত ও তার প্রামাণ্যতা
এ রাতের ফজিলত সম্পর্কিত একাধিক সহি হাদিস বর্ণিত হয়েছে। একটি উল্লেখ করা হলো– হজরত মুআজ ইবনে জাবাল (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহতায়ালা অর্ধশাবানের রাতে (শবে বরাত) সৃষ্টির প্রতি রহমতের দৃষ্টি দেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ছাড়া আর সবাইকে ক্ষমা করে দেন।’ (মুসনাদে আহমদ : ৪/১৭৬)
শবে বরাতের ক্ষেত্রে ছাড়াছাড়িতে লিপ্ত অনেকে এই হাদিসটিসহ শাবানের রাতের সব হাদিসকে অস্বীকার করেন এবং শবে বরাতকে বিদআত বলেন। কিন্তু ইমাম মুনযিরী, ইবনে রজব, নুরুদ্দীন হাইসামী, কাসতাল্লানী, যুরকানীসহ আরও অনেক হাদিস বিশারদ এটিকে সহি বলেছেন। শুধু তাই নয়; শায়খ নাসিরুদ্দিন আলবানীও (রহ.) সিলসিলাতুল আহাদিসিস সাহিহা গ্রন্থে এই হাদিসের সমর্থনে আরও আটটি হাদিস উল্লেখ করেছেন এবং বলেছেন, এসব বর্ণনার মাধ্যমে সমষ্টিগতভাবে এই হাদিসটি নিঃসন্দেহে সহি প্রমাণিত হয়। (সিলসিলাতুল আহাদিসিস সাহিহাহ: ৩/১৩৫-১৩৯)। সুতরাং শবে বরাত আছে এবং এটি একটি ফজিলতপূর্ণ রাত–হাদিসের আলোকে এটি নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হলো।
শবে বরাতে কি ভাগ্য লেখা হয়?
অনেকে বিশ্বাস করেন, ফজিলতপূর্ণ এ রাতে সৃষ্টিকুলের ভাগ্য লেখা হয়। এক্ষেত্রে তারা পবিত্র কোরআনের এই আয়াতটি প্রমাণ হিসেবে পেশ করেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হা-মিম! শপথ! উজ্জ্বল কিতাবের, নিশ্চয়ই আমি তা নাজিল করেছি এক বরকতময় রাতে; নিশ্চয়ই আমি ছিলাম সতর্ককারী। যাতে সব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নির্ধারিত হয়। এ নির্দেশ আমার তরফ থেকে, নিশ্চয়ই আমিই দূত পাঠিয়ে থাকি।’ (সুরা দুখান, আয়াত: ১-৫)। আয়াতে উল্লেখিত ‘বরকতময় রাত’কে ইকরিমা (রহ.)-সহ কয়েকজন তাফসিরবিদ ‘শবে বরাত’ দাবি করেছেন। তবে পবিত্র কোরআনের অন্য দুটি আয়াতের দিকে নজর দিলে খুব সহজেই স্পষ্ট হয় যে–এখানে ‘বরকতময় রাত’ দ্বারা শবে বরাত নয়; বরং শবে কদরকে বোঝানো হয়েছে।
কারণ, আমরা জানি–পবিত্র কোরআন নাজিল হয়েছে রমজান মাসে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘রমজান মাস! যে মাসে কোরআন নাজিল হয়েছে মানবের দিশারিরূপে ও হিদায়াতের সুস্পষ্ট নিদর্শন হিসেবে।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ১৮৫) অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই আমি এটি (কোরআন) নাজিল করেছি লাইলাতুল কদরে।’ (সুরা আল কদর, আয়াত : ১)
শেষোক্ত দুই আয়াতের প্রথমটিতে স্পষ্ট করা হয়েছে যে পবিত্র কোরআন রমজান মাসে নাজিল হয়েছে আর দ্বিতীয় আয়াতে বলা হয়েছে, কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে লাইলাতুল কদরে। প্রথম আয়াত যে মাসটির (রমজান) কথা উল্লেখ করেছে ওই মাসেরই একটি রাত হলো লাইলাতুল কদর তথা শবে কদর। এই দুই আয়াত স্পষ্ট করছে যে সুরা দুখানে উল্লেখিত ‘বরকতময় রাত’ দ্বারাও শবে কদরকে নির্দিষ্ট করে বলা হয়েছে। কেননা, কোরআন নাজিল হয়েছে রমজান মাসে, শবে কদরে। এখানে ‘বরকতময় রাত’ দ্বারাও সেটিই বলা হয়েছে। তাই একথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে সৃষ্টির ভাগ্য লেখা হয় শবে কদরে; শবে বরাতে নয়।
শবে বরাত সম্পর্কে একটি চমৎকার উক্তি
দেশের অন্যতম শীর্ষ ইসলামি গবেষণা প্রতিষ্ঠান মারকাযুদ দাওয়াহ আল ইসলামিয়া। ইসলামের উচ্চতর পড়াশোনার এই প্রতিষ্ঠানের সহ-প্রতিষ্ঠাতা, শিক্ষা সচিব ও উচ্চতর হাদিস বিভাগের প্রধান মুফতি আব্দুল মালেক (দা: বা:)। সর্বজন শ্রদ্ধেয় এ আলেম শবে বরাত সম্পর্কে চমৎকার অভিমত দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘শবে বরাত সম্পর্কে সঠিক ও ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান হলো– এ রাতের ফজিলত সহি হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। সম্মিলিত কোনও রূপ না দিয়ে এবং এই রাত উদযাপনের বিশেষ কোনও পন্থা উদ্ভাবন না করে বেশি ইবাদত করাও নির্ভরযোগ্য বর্ণনা দ্বারা প্রমাণিত। এই রাতকে অন্য সব সাধারণ রাতের মতো মনে করা এবং এ রাতের ফজিলত সম্পর্কে যত হাদিস এসেছে সবগুলোকে মওযু (বানোয়াট) বা জঈফ (দুর্বল) মনে করা যেমন ভুল, তেমনি এ রাতকে শবে কদরের মতো বা তার চেয়েও বেশি ফজিলতপূর্ণ মনে করাও একটি ভিত্তিহীন ধারণা। (আলকাউসার, সেপ্টেম্বর-২০০৫)।
আল্লাহ আমাদের সবাইকে দ্বীনের প্রতিটি বিষয় সঠিকভাবে বুঝে তা পরিপালনের তাওফিক দান করেন। আমিন।