ঢাকা,  বৃহস্পতিবার  ২১ নভেম্বর ২০২৪

নিউজ জার্নাল ২৪ :: News Journal 24

বাংলাদেশে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি: জেন্ডার প্রেক্ষিত সম্মেলন অনুষ্ঠিত

নিউজজার্নাল২৪ প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ১০:২৭, ১০ মার্চ ২০২৪

বাংলাদেশে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি: জেন্ডার প্রেক্ষিত সম্মেলন অনুষ্ঠিত

‘বাংলাদেশে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি: জেন্ডার প্রেক্ষিত’ বিষয়ক একটি দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। শনিবার (৯ মার্চ) ঢাকার ইন্টারকন্টিনেন্টালে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।

বাংলাদেশের একটি গবেষণা সংস্থা ‘সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (সিআরডি)’ এই সম্মেলনের আয়োজন করে। এ সম্মেলনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে পরিচালিত একটি গবেষণার ফলাফল উপস্থাপন করা হয়। স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ণ স্টেকহোল্ডার, নীতিনির্ধারক, শিক্ষাবিদ এবং বিশেষজ্ঞরা এক্ষেত্রের আর্থিক অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে জেন্ডার বৈষম্য দূর করার কৌশলগুলো সম্পর্কে মতামত প্রদান করেন।

এ গবেষণার প্রধান চারজন গবেষক হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. আয়েশা বানু; বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রাক্তন নির্বাহী পরিচালক ড. লীলা রশিদ; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সায়মা হক বিদিশা এবং সিআরডি’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. মো. মোখলেছুর রহমান।

উদ্বোধনী অধিবেশনে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান এবং সমাপনী অধিবেশনে প্রধান অতিথি ছিলেন ইনস্টিটিউট ফর ইনকুসিভ ফিনান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ওহগ) এর নির্বাহী পরিচালক ড. মুস্তাফা কে মুজেরি।  এ অধিবেশনে আরো উপস্থিত ছিলেন বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের ইনকুসিভ ফিন্যান্সিয়াল সিস্টেমসের ডেপুটি ডিরেক্টর হিলারি মিলার-ওয়াইজ, স্ট্র্যাটেজিক ইনভেস্টমেন্ট ফান্ডের ডেপুটি ডিরেক্টর লিন আইজেনহার্ট এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর নুরুন নাহার। এর পাশাপাশি এ সম্মেলনে বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের অন্যান্য প্রতিনিধিবৃন্দও উপস্থিত ছিলেন।

সম্মেলনের প্রথম ভাগে বাংলাদেশে আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে জেন্ডার বৈষম্য শীর্ষক আড়াই বছরের গবেষণা প্রকল্পের ফলাফল উপস্থাপন করা হয়। অধিবেশনটি সঞ্চালনায় ছিলেন ফাউন্ডেশনের ইনকুসিভ ফিন্যান্সিয়াল সিস্টেমস-এর বাংলাদেশ কান্ট্রি লিড স্নিগ্ধা আলী।

গবেষণায় ৫৬টি জেলার ২২০টি কাস্টারের ভিত্তিতে ৩,৩০০টি পরিবারের ৭,৫৬০ জন ব্যক্তির উপর দেশব্যাপী পরিচালিত জরিপের ফলাফল উপস্থাপন করা হয়। এর পাশাপাশি গুণগত গবেষণার অংশ হিসেবে ৬৪টি দলগত আলোচনা, ৪৯টি নিবিড় সাক্ষাতকার এবং ৫৬টি বিশেষজ্ঞ সাক্ষাতকার গ্রহন করা হয়েছে। জরিপের ফলাফল থেকে দেখা গেছে যে আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে ৬.৯০ শতাংশ পয়েন্ট জেন্ডার গ্যাপ রয়েছে, যদিও বিশদ বিশ্লেষণে দেখা গেছে যে এই গ্যাপের ব্যাপ্তি ও গভীরতা আরও অনেক ব্যাপক। গবেষণায় মোবাইলভিত্তিক আর্থিক সেবায় জেন্ডার গ্যাপ সবচেয়ে বেশি পাওয়া গেছে (৩৫.৪২ শতাংশ পয়েন্ট)। এছাড়া  ব্যাংকিং খাতে ১৭.২৮ শতাংশ পয়েন্ট জেন্ডার গ্যাপ রয়েছে। অন্যদিকে ক্ষুদ্র্ঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোতে ৬১.৯৫ শতাংশ নারী অন্তর্ভুক্ত রয়েছে যেখানে পুরুষের অন্তর্ভুক্তি মাত্র ৫.৫৮ শতাংশ। গবেষণায় আরও দেখা গেছে যে, আর্থিক অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে পুরুষের তুলনায় নারীরা  যে শুধু পিছিয়েই রয়েছে তাই নয়, ব্যাংকের মতো আনুষ্ঠানিক আর্থিক সেবার ক্ষেত্রেও তারা প্রান্তিক অবস্থানে রয়েছে। গবেষণায় আরো দেখা গেছে যে, আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে নারী-পুরুষের ব্যবধানের তিন চতুর্থাংশ (৭৬ শতাংশ) অর্থনৈতিক অবস্থান, শিা, কর্মসংস্থান, খানা কাঠামো ও বৈবাহিক অবস্থা ইত্যাদি আর্থ-সামাজিক বিষয়গুলোর মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা যায়। আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে নারী-পুরুষের ব্যবধানের বাকি ২৪ শতাংশ এ ধরনের দৃশ্যমান সূচকের মাধ্যমে বিশ্লেষণ করা যায় না। এক্ষেত্রে সামগ্রিক বিশ্লেষণাত্মক দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন।

গবেষণাটিতে গুণগত বিশ্লেষণের মাধ্যমে জেন্ডার ব্যবধানের সূক্ষ্ম দিকগুলোকে খুঁজে বের করে জেন্ডার বৈষম্যের স্তর ও ব্যাপ্তি উন্মোচন করা হয়। জেন্ডার মতাদর্শ, সামাজিক রীতি-নীতি ও বিধিনিষেধ নারীদের আর্থিক অন্তর্ভুক্তিকে উলে­খযোগ্যভাবে বাধাগ্রস্ত করে বলে গবেষণায় উঠে আসে। নারীরা অবমাননাকর মন্তব্য এবং সামাজিক নিষেধাজ্ঞার সম্মুখীন হয়, যা তাদের কাজ ও সক্রিয় ভূমিকাকে ঘরে ও বাইরে সীমাবদ্ধ করে দেয়। এই প্রথাগুলো আর্থিক সেবা প্রদানকারী ও গ্রহণকারীদের মানসিকতাকেও প্রভাবিত করে এবং আর্থিক অন্তর্ভুক্তির পূর্বশর্ত যেমন সম্পদের উপর নিয়ন্ত্রণ এবং কর্মসংস্থানের সুযোগগুলোতে নারীদের অভিগম্যতাকেও বাধাগ্রস্ত করে। প্রতিষ্ঠানিক কাঠামো ও নীতি কাঠামোও এই প্রথাগুলো দ্বারা প্রভাবিত হয়।

অনেক বাধাবিপত্তি সত্তে¡ও, কিছু নারী আর্থিক অন্তর্ভুক্তির একটি নির্দিষ্ট স্তরে পৌঁছেছেন, যা ইতিবাচক পরিবর্তন হিসাবে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। তবে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, স্বামী বা মূল উপর্জনকারীর মৃত্যু, অসুস্থতা ও চিকিৎসা ব্যয়ের মতো বিষয়সমূহ এ নারীদের ক্ষেত্রে চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছে।

গবেষণালব্ধ ফলাফলের ভিত্তিতে গবেষকগণ কিছু সুপারিশ তুলে ধরেন, যেমন নারীদের তথ্য প্রাপ্তিতে এবং ডিজিটাল ডিভাইসে অভিগম্যতা নিশ্চিত করা, ব্যাংকের শাখাগুলোতে জেন্ডার-বান্ধব ব্যবসায়িক পরিবেশ এবং ঋণ ও অন্যান্য সেবার ক্ষেত্রে জেন্ডার বৈষম্য কমানোর জন্য একটি বিশদ কর্ম পরিকল্পনা প্রণয়নসহ বিস্তৃত উদ্যোগ গ্রহন, সেই সাথে জেন্ডার ব্যবধান কমানোর ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তাদের জন্য আর্থিক প্রণোদনা বাড়ানো এবং এর বাস্তবায়ন। আর্থিক এবং ডিজিটাল সারতার জন্য সচেতনতা এবং দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণের উপর জোর দেওয়া, টেকসই প্রচারাভিযান এবং সচেতনতা বাড়াতে অ্যাডভোকেসি ইত্যাদি।

উপরোলি­খিত সুপারিশ ছাড়াও, নারীদের আর্থিক অন্তর্ভুক্তির পরিসর বৃদ্ধির জন্য গবেষণায় নারীদের কর্মসংস্থান ও আয়ের প্রতিও দৃষ্টি নিবদ্ধ করা হয়, এছাড়াও সম্পত্তিতে নারীদের অধিকারহীনতা, মজুরিবিহীন সেবামূলক কাজের অবমূল্যায়ন, বাল্যবিবাহ এবং জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতা ইত্যাদি বিষয়গুলো সর্বোচ্চ স্তর থেকে মোকাবেলা করার জন্য সুপারিশ করা হয়।

সম্মেলনের দ্বিতীয় ভাগের প্লেনারি অধিবেশনে বৈশ্বিক ও স্থানীয় অভিজ্ঞতা বিনিময় পর্বে বিশেষজ্ঞরা আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বিষয়ে তাদের মতামত প্রদান করেন ও অভিজ্ঞতা বিনিময় করেন।

সম্মেলনের সমাপনী অধিবেশনে ড. মুস্তাফা কে মুজেরির সভাপতিত্বে আলোচনা করেন মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির এক্সিকিউটিভ ভাইস চেয়ারম্যান মো. ফসিউল­াহ, বিবি প্রোডাকশনসের প্রতিষ্ঠাতা বিবি রাসেল, বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের ডিজিটাল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের সিনিয়র প্রোগ্রাম অফিসার মারিয়া আলেকসান্দ্রা মে। আয়োজকদের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ প্রদান করেন ড. মো. মোখলেছুর রহমান।

 

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন